করোনায় চিংড়িশিল্প বিপর্যস্ত

সিটি নিউজ ডেস্ক: করোনা মহামারির প্রভাব পড়েছে বাগেরহাটের চিংড়িশিল্পে। পোনা-সংকট ও রপ্তানি কমে যাওয়ায় বিপর্যয়ের মুখে পড়েছেন জেলার চিংড়িচাষিরা। তারা বলছেন, পর্যাপ্ত সরকারি সহায়তা না পেলে এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব নয়।

১৪ এপ্রিল থেকে সারা দেশে শুরু হওয়া কঠোর লকডাউনে চিংড়ি পোনা পরিবহন বন্ধ রয়েছে। মৌসুমের শুরুতে ঘের পরিচর্যা শেষ করলেও চাহিদা অনুযায়ী পোনা ছাড়তে না পারায় গত বছরের মতো এবারও আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছেন চাষিরা।

এদিকে পরিবহন বন্ধ থাকায় গলদা-বাগদা পোনার দাম বেড়েছে কয়েক গুণ। অনেকেই বাধ্য হয়ে বেশি দামে পোনা কিনছেন। এ অবস্থায় দিশেহারা হয়ে পড়েছেন চিংড়িশিল্পের সঙ্গে জড়িত লক্ষাধিক মানুষ।

দেশের সবচেয়ে বেশি চিংড়ি চাষ হয় বাগেরহাটে। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সবচেয়ে বড় চিংড়ি পোনার হাট রামপালের ফয়লাহাটে প্রতিদিন প্রায় কোটি টাকার কেনাবেচা হয়। সরেজমিনে দেখা যায়, হাটে এখন আর আগের মতো কর্মব্যস্ততা নেই। লকডাউনের প্রভাবে পোনা পরিবহনে সংকট দেখা দেয়ায় শূন্য হাঁড়ি নিয়ে বসে আছেন বিভিন্ন আড়তের শ্রমিকরা। অনেকটা বেকার হয়ে পড়েছেন ব্যবসায়ী, শ্রমিকসহ এই হাটের সঙ্গে জড়িত প্রায় ৪-৫ হাজার মানুষ।

হাটের আড়তদার মো. মনিরুজ্জামান বলেন, চট্টগ্রাম, ফেনী, নোয়াখালী ও কক্সবাজার থেকে বাগদা ও গলদা পোনা আসে এই হাটে। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত প্রায় কোটি টাকার পোনা বেচাকেনা হয়। তবে করোনা মহামারিতে আগের মতো চিংড়ি পোনার সরবরাহ না থাকায় চাষিদের চাহিদা অনুযায়ী পোনা সরবরাহ করা যাচ্ছে না।

হাটে চিংড়ি পোনা গণনার কাজ করা তরিকুল ইসলাম বলেন, ‘লকডাউনের কারণ ফয়লাবাজারে মাছ আসতে পারছে না। এ অবস্থায় আমাদের ভিক্ষার থালা নিয়ে বসতে হবে। আমি লেখাপড়া করি কিন্তু আমার ফ্যামিলিকে সাপোর্ট দেয়ার জন্য বাজারে আসতে হচ্ছে।’

তিনি বলেন, ‘এক হাজার মাছ গুনলি আমি বিশটা টাকা পাই। এই বিশটা টাকার জন্য আজকে আমাকে বাজারে আসতে হচ্ছে। এরপরও যদি লকডাউন দিয়ে এটা বন্ধ করে দেয়া হয় তাহলে এই বিশটা টাকা কে আমাকে দেবে?’

আরেক গণনাকারী হাকিম শেখ বলেন, ‘পোনাপাতি আসতিছে না, তালি আমরা কী করে বাঁচপো? বাড়িতি ছেলে-মেয়ে আছে, মা আছে। আমাদের তো না খেয়ে মরার পথ।’

চিংড়িচাষি হারুন শেখ সদর উপজেলার ষাটগম্বুজ ইউনিয়নের সায়ড়া গ্রামের বাসিন্দা।

তিনি বলেন, ‘আমি আইজ ১২-১৩ বছর ঘের করি। আমার ঘেরের পরই সংসার চলে। এই করোনার সময় আইসে মাছের রেট কুমে গেইছে।’

হারুন বলেন, ‘আগে মাছ বিক্রি করিছি ১৩-১৪০০ টাকা, এখন সেই মাছের দাম ৬০০-৯০০ টাকা। আমার ১০-১২ বিঘের দুটি ঘের আছে। আমি যা ইনভেস্ট করেছি, তার অর্ধেক টাকাও উঠবে না।’

সদরের রাধাভল্লব এলাকার চিংড়িচাষি আতিয়ার গাজী বলেন, ‘আমরা ঘের রেডি করে রাইছি। মাছ ছারতি পারতিছিনা, করোনার কারণে। মাছ পাওয়া যাচ্ছে না, কম কম আসে, দাম বেশি।’

তিনি বলেন, ‘আগে এক হাজার বাগদা পোনার দাম ছিল ৩০০ টাকা। এহন দাম ৬০০ টাকা। নদীর বাগদা ছিল ৭০০ টাকা, এহন ১২০০-১৪০০ টাকাতেও পাওয়া যাচ্ছে না। রেণু (গলদা) হালকাপাতলা পাওয়া যাচ্ছে। দাম হাজারে ৩০০০-৩২০০ টাকা।’

সদর উপজেলার বারাকপুর চিংড়ি আড়তদার সমিতির সভাপতি জাকির হোসেন বলেন, করোনার সময় চিংড়িশিল্পে ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। ১৭০০ টাকার চিংড়ি মাছ ৮০০-৯০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। চিংড়িশিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে চাষিদের সরকারি সহায়তার প্রয়োজন। তা না হলে এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব নয়।

বাগেরহাট মৎস্য অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী জেলায় চিংড়িচাষি রয়েছেন ৭৯ হাজার ৭৩৬ জন।

৭১ হাজার ৮৮৬ হেক্টর জমিতে বাগদা ও গলদা চিংড়ির ঘের রয়েছে ৮১ হাজার ৩৫৮টি। এসব ঘেরে ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১৭ হাজার ৪৮৭ মেট্রিক টন বাগদা ও ১৬ হাজার ৩৩৭ মেট্রিক টন গলদা চিংড়ি চাষ হয়েছে।

জেলা মৎস্য কর্মকর্তা এস. এম রাসেল বলেন, মহামারির প্রভাবে বর্তমানে রপ্তানি বন্ধ থাকায় মাছের দাম অনেকটা কমে গেছে। এর ফলে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন প্রান্তিক চাষিরা। রপ্তানি বন্ধ থাকায় গত এক বছরে বাগেরহাটের চিংড়িশিল্পে ক্ষতির পরিমাণ ১৪০ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে এই ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ২৫০ কোটি টাকা।

তিনি বলেন, এরই মধ্যে বাজারে পোনা-সংকটও দেখা দিয়েছে। বাগেরহাটে ৭৭ কোটি বাগদা ও ২১ কোটি গলদা পোনার চাহিদা রয়েছে। করোনার প্রভাবে লকডাউন চলতে থাকলে কোনোভাবেই এই পরিমাণ পোনার চাহিদা মেটানো সম্ভব নয়।

এস. এম রাসেল বলেন, এ অবস্থা চলতে থাকলে সময়ের সঙ্গে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়বে। তবে চাষিদের ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে সরকার বেশ কিছু পরিকল্পনা নিয়েছে। এর অংশ হিসেবে জেলার ২৮ হাজার মৎস্যচাষিকে আর্থিক প্রণোদনার পাশাপাশি সহজ শর্তে ব্যাংক ঋণ দেয়া হচ্ছে।

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin