করোনায় বিপর্যস্ত বরিশালের চামড়া শিল্প

শফিক মুন্সি, বরিশাল ‍॥ এক সময় পুরো দক্ষিণাঞ্চলে কোরবানি হওয়া সকল পশুর চামড়া সংগ্রহ করে সেগুলো প্রাথমিক প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং ট্যানারি মালিকদের কাছে পাঠানোর জন্য নিয়ে আসা হতো বরিশাল নগরীর কাঠপট্টি এলাকায়।

সেখানকার ষাটোর্ধ্ব বাসিন্দা আবদুল মতিন মোল্লা। তিনি বলেন, ‘ভারতের দক্ষিণের চিত্তৌর রাজ্যের রাণী পদ্মাবতীর রূপে মুগ্ধ হয়েছিলো দেশ বিদেশের রাজা-বাদশারা। তাকে নিজের করতে রাজায়-রাজায় যুদ্ধ হয়েছে অনেক। আমাদেরও এক জৌলুসপূর্ণ পদ্মাবতী ছিলো। কিন্তু সময়ের ফেরে সে রূপ হারিয়েছে।’
মতিন মোল্লার ‘পদ্মাবতী’ কোনো রূপবতী নারী বা রাণী নয়। কাঠপট্টি এলাকার ছোট একটি অংশ। যেটা চামড়া (ট্যানারি) শিল্পের জন্য এই দেশের দক্ষিণাঞ্চল জুড়ে বিখ্যাত ছিলো এক সময়। কিন্তু এই শিল্পের বেহাল দশার কারণে এখানে এখন আর চামড়া নিয়ে ব্যস্ততা নেই। সংকট ছিলো আগে থেকেই, তবে করোনা সংক্রমণ পুরো ব্যবসাকে করে দিয়েছে বিপর্যস্ত। কিন্তু মাত্র বছর পাঁচেক আগেও এমন অবস্থা ছিলো না।

সময়ের বিবর্তনে চামড়া ব্যবসায়ীদের কেউ ছেড়েছেন পদ্মাবতী, আবার কেউ পদ্মাবতী এলাকায় নিজ স্থানে থেকেই শুরু করেছেন ভিন্ন ব্যবসা। শুধু ব্যবসায়ী নয়, চামড়া শিল্পের সঙ্গে যে শ্রমিকরা জড়িত ছিলেন, তাদের মধ্যেও অনেকেই ছেড়ে গেছেন পদ্মাবাতী। আর যারাও এখনও কোনো না কোনোভাবে টিকে রয়েছেন তারাও যে খুব একটা ভালো দিন কাটাচ্ছেন তেমন না। আর এগুলোর মূলে কারণ হিসেবে রয়েছে স্থানীয় পর্যায়ে চামড়ার ক্রমাগত দরপতন এবং কিছু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের আধিপত্য। একইসঙ্গে চলমান করোনা পরিস্থিতি এই শিল্পের কফিনে শেষ পেরেক ঠুঁকে দেবার সকল আয়োজন সম্পন্ন করেছে।

মাত্র কয়েক বছর আগেও পদ্মাবতী এলাকায় প্রায় ২০০ জন ব্যবসায়ী চামড়া ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। আর এসব ব্যবসায়ীদের সঙ্গে নির্দিষ্ট মৌসুমে কাজ করতেন হাজার খানেক শ্রমিক। পুরো বরিশাল বিভাগের পশুর চামড়া সংগ্রহ করে প্রক্রিয়াজাতকরণ করে ঢাকার পাইকারদের কাছে পাঠাতেন তারা। এখন সেখানে দুই থেকে তিনজন ব্যবসায়ী নিয়মিত কোনোরকমে ব্যবসাটা টিকিয়ে রেখেছেন।
এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন বরিশাল জেলা চামড়া ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক এবং পদ্মাবতীর পুরনো বাসিন্দা শহিদুর রহমান শাহীন। তিনি জানান, পারিবারিকভাবে বাপ-দাদার আমল থেকেই তিনি এ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। কিন্তু চামড়ার দাম কমে যাওয়ায় এবং পাইকারদের কাছ থেকে টাকা না পাওয়ায় লাখ লাখ টাকা লোকসান দিতে হয়েছে তাকে। তাই গত কয়েক বছর যাবৎ ব্যবসা পরিবর্তন করে এখন কাপড়ের দোকানের মালিক হয়েছেন তিনি। কিন্তু হাতে গোনা যে কয়েকজন ব্যবসায়ী এখনো এই ব্যবসায় আছে তারা সমিতির দায়িত্ব না নেয়ায় তাকেই সমিতি চালাতে হচ্ছে।
তিনি বলেন, ‘আমরা চামড়া ব্যবসা ছেড়েছি মূলত ঢাকার পাইকার এবং ট্যানারি কারখানার মালিকদের জন্য। তাদের কাছে আমাদের অনেক টাকা পাওনা। তারা আমাদের কাছ থেকে চামড়া নিয়ে যায় ঠিকই কিন্তু চাহিদা মাফিক টাকা দেয় না। এছাড়া বর্তমানে চামড়ার দাম কম। ছোট পশু যেমন ছাগলের চামড়ার কোনো মূল্য নেই। বড় পশুর চামড়ার জন্য সর্বোচ্চ ৮০ থেকে ১০০ টাকা বরাদ্দ থাকে। এই মূল্যে চামড়া বিক্রি করতে গিয়ে আমাদের খরচের টাকাই ওঠে না।’
অন্যদিকে পদ্মাবতী এলাকায় দীর্ঘদিন চামড়া ব্যবসায় শ্রমিক হিসেবে কাজ করেছেন রতন সন্নামত। তিনি এখন পেশা বদলে কাঠপট্টি এলাকায় একটি ফলের দোকানে কর্মচারী। তিনি জানান, শুধু কোরবানির সময়ে কাজ করে যা উপার্জন হতো তা দিয়েই সারা বছর চলতো তাদের। বিভিন্ন স্থান থেকে পশুর চামড়া সংগ্রহ করা, সেগুলোতে লেগে থাকা চর্বি – মাংসের অংশবিশেষ তুলে ফেলা, লবণ কিংবা রাসায়নিক দিয়ে সেগুলো সংরক্ষণ এবং সর্বশেষ ঢাকায় পাঠানোর জন্য পরিবহনে তোলার ব্যবস্থা করতেন তারাই।
দীর্ঘ ১৭ বছর পদ্মাবতীর চামড়া শিল্পে জড়িত থাকা এই শ্রমিক বলেন, ‘কয়েক বছর আগে হঠাৎ ঢাকার পাইকাররা চামড়ার দাম এতটাই কমিয়ে দিলো যে, স্থানীয় ব্যবসায়ীরা চামড়া পরিবহনের খরচই ওঠাতে পারতো না। একের পর এক ব্যবসায়ী চামড়া ব্যবসা থেকে নিজেদের গুটিয়ে নেওয়ায় তার মতো শত শত শ্রমিক পেটের দায়ে পদ্মাবতীকে ভুলে এখন অন্যত্র নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনে ব্যস্ত।’
আর বর্তমান করোনা সংক্রমণ ও লকডাউন পরিস্থিতিতে স্থানীয় পর্যায়ে চামড়া কেনাবেচা থমকে যেতে পারে ধারণা করছেন এখনো পদ্মাবতীতে টিকে থাকা গুটিকয়েক চামড়া ব্যবসায়ীদের কেউ কেউ। এ ব্যাপারে কালাম গাজী নামের এক ব্যবসায়ী বলেন, ‘করোনা সংক্রমণে পশু কোরবানি গতবছর কম হয়েছে। এ বছরও কমই হবে বলে মনে করছি। এর ওপর লকডাউন জারি থাকলে চামড়া কেনা কিংবা পরিবহন করতেও সমস্যা হবে।’
স্থানীয় প্রশাসনের কাছ থেকে এ ব্যাপারে সহযোগিতা প্রত্যাশা করে তিনি বলেন, ‘আমরা মূলত পাইকারদের কাছ থেকে টাকা এনে স্থানীয় পর্যায়ে চামড়া কিনি। কিন্তু পাইকার বা ট্যানারি মালিকেরা পর্যাপ্ত টাকা দেয় না বিধায় আমাদের লোকসান হয়। করোনা পরিস্থিতি বিবেচনায় যদি স্থানীয় প্রশাসন মাত্র কয়েক মাসের জন্য আমাদের প্রণোদনা বাবদ ঋণের ব্যবস্থা করে তবে অন্তত টিকে থাকতে পারি। আর করোনা পরিস্থিতির মধ্যে চামড়া কিনতে ও পরিবহন করতে অনুমতি ও সহযোগিতা পেলে ভালো হয়।’

এসব ব্যাপার নিয়ে আলোচনাকালে বরিশালের জেলা প্রশাসক জসীম উদ্দীন হায়দার বলেন, ‘সরকারি প্রণোদনা প্রাপ্তির জন্য তাদেরকে আমার কাছে আবেদন করতে হবে। চামড়া শিল্প টিকিয়ে রাখতে যদি সত্যি তাদের আর্থিক সহযোগিতার দরকার হয় তবে অবশ্যই সরকার তাদের পাশে থাকবে। তবে কোরবানির সময়ে যদি চলমান সরকারি নিষেধাজ্ঞা জারি থাকে তবে তাদের চামড়া সংগ্রহ কিংবা পরিবহনে আমরা কোনো মুভমেন্ট পাশ দিতে পারবো না’। 

এদিকে চামড়ার দাম কমে গেলেও চামড়াজাত পণ্যের দামের ঊর্ধ্বগতি ঠিক মেনে নিতে পারেন না ষাটোর্ধ মতিন মোল্লা। তিনি বলেন, ‘ছোটবেলা থেকে পদ্মাবতীর অলিতে গলিতে হেঁটে জীবন পার করলাম। চামড়ার দাম কমে যাওয়ায় যখন দেখি একের পর এক ঐতিহ্যের স্বাক্ষর রাখা পশুর চামড়ার দোকানগুলোতে তালা পড়ছে, তখন খারাপ লাগে। কিন্তু চামড়ার জুতার দোকানে গিয়ে যখন দেখি প্রতিনিয়ত চামড়াজাত পণ্যগুলোর দাম বাড়ছে তখন মনের মধ্যে খটকা লাগে। শুধুই চামড়ার দাম না থাকায় শৈশব থেকে দেখে আসা চামড়া ব্যবসায়ীদের দুর্দশায় পড়তে হচ্ছে এমনটা তখন আর বিশ্বাস হয় না। মনে হয় চামড়া শিল্প ধ্বংসের পিছনে অন্য কোনো ষড়যন্ত্র চলছে।’ 

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin