দ্বিমুখী চাপে সাদিক, মাঠ দখলের চেষ্টা জাহিদের

সিটি নিউজ ডেস্ক ‍॥ দ্বিমুখী চাপে পড়েছেন বরিশাল সিটি করপোরেশনের মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ। প্রশাসনের সঙ্গে দ্বন্দ্ব অপরদিকে সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলররা সঙ্গ ছাড়ায় বেকায়দায় তিনি। বলা যায় ঘর ভাঙছে সাদিকের।

সাদিকের পক্ষ ছেড়ে সদর আসনের সংসদ সদস্য পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুখের কাছে ভিড়ছেন কাউন্সিলর এবং আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। অনেক আওয়ামী লীগ নেতা গোপনে সম্পর্ক রাখলেও ৯ কাউন্সিলর প্রতিমন্ত্রীর দলে ভিড়েছেন প্রকাশ্যেই।

সঙ্গ পাল্টানো কাউন্সিলররা বলছেন, সাদিক আব্দুল্লাহর অত্যাচার ও স্বেচ্ছাচারিতার মধ্যে থাকতে হয়েছে এতদিন। তাই তারা সদর আসনের সংসদ সদস্যের সঙ্গে আলোচনা করেছেন কীভাবে উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করা যায়।

গত ১৮ আগস্ট রাতে বরিশালে সংঘর্ষের ঘটনার পর সমঝোতা হলেও বরিশাল জেলা প্রশাসকের বক্তব্য নিয়ে নতুন করে শুরু হয়েছে আলোচনা। অপরদিকে সম্প্রতি ফেসবুক লাইভে এসে নেতাকর্মীদের পেছনের কথা ভুলে সামনের দিকে এগিয়ে কাজ করার নির্দেশনা দেন মেয়র সাদিক।

১৮ আগস্ট রাতে বরিশাল সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মুনিবুর রহমানের ওপর হামলার অভিযোগে আনসার সদস্যদের ছোড়া গুলিতে সাদিক আব্দুল্লাহসহ আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের ৩০ নেতাকর্মী আহত হওয়ার অভিযোগ ওঠে।

এরপর পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ হলে পরের দিন ইউএনও ও পুলিশ মামলা করে, যাতে প্রধান আসামি করা হয় সাদিক আব্দুল্লাহকে।

পরিস্থিতি গুমোট হওয়ার এক পর্যায়ে ২২ আগস্ট সমঝোতা বৈঠক হয় বরিশাল বিভাগীয় কমিশনারের বাসভবনে। মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি একেএম জাহাঙ্গীর হোসেন সমঝোতার বিষয়টি নিশ্চিত করে মামলা তুলে নেয়ার সিদ্ধান্তের কথা জানান। তবে প্রায় তিন সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও মামলা তুলে নেয়ার কোনো প্রক্রিয়ার খবর আসেনি।

২৯ আগস্টে বরিশাল সদর আসনের সংসদ সদস্য পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুখের উপস্থিতিতে ওই সভায় জেলা প্রশাসক তার সঙ্গে বরিশাল-২ আসনের সংসদ সদস্য শাহ আলম এবং বরিশাল-৪ আসনের সংসদ সদস্য পঙ্কজ দেবনাথের সুসম্পর্কের কথাও বলেন।

এই দুই সংসদ সদস্য বরিশালের রাজনীতিতে বরিশাল-১ আসনের সংসদ সদস্য আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহর বিরোধী বলে প্রচার রয়েছে। হাসনাতপুত্র হওয়ায় সাদিকের সঙ্গেও তাদের সম্পর্ক খুব একটা ভালো নয়।

প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলা সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলররা হলেন- ১ নম্বর ওয়ার্ডের আমীর বিশ্বাস, ৪ নম্বর ওয়ার্ডের তৌহিদুল ইসলাম বাদশা, ১২ নম্বর ওয়ার্ডের জাকির হোসেন ভুলু, ২০ নম্বর ওয়ার্ডের জিয়াউর রহমান বিপ্লব, ২২ নম্বর ওয়ার্ডের আনিসুর রহমান দুলাল, ২৩ নম্বর ওয়ার্ডের এনামুল হক বাহার, ২৪ নম্বর ওয়ার্ডের শরীফ মো. আনিসুর রহমান, ২৬ নম্বর ওয়ার্ডের হুমায়ন কবির এবং ২৯ নম্বর ওয়ার্ডের ফরিদ আহম্মেদ। এরা সবাই সাদিক আব্দুল্লাহর একনিষ্ঠ অনুসারী ছিলেন।

কাউন্সিলর আনিছুর রহমান দুলাল বলেন, ‘আমরা মেয়র সাদিক আবদুল্লাহর অসহযোগিতা ও স্বেচ্ছাচারিতার শিকার। বরিশালে যে গুমোট রাজনৈতিক অবস্থা বিরাজ করছিল, এর পরিবর্তন করা যায় কি-না এবং সাংগঠনিক ও উন্নয়ন কার্যক্রম নিয়ে প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করেছি। কারও সঙ্গে কোনো সংঘাতে আমরা যাব না।’

তিনি বলেন, ‘বিএনপির লোকজন নিয়ে মহানগর আওয়ামী লীগের কমিটি হয়েছে। অথচ আমরা দলে ভালো জায়গা পাই না।’

কাউন্সিলর শরীফ আনিছুর রহমান বলেন, ‘আমরা কারও বিরুদ্ধে যাইনি। দলের স্বার্থে প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছি। যেখানে সম্মান পাওয়া যায় না, পদে পদে হেনস্তা হতে হয়, সেই বলয়ে থেকে লাভ কী? শুধু আমরাই নই, আরও প্রায় অর্ধডজন কাউন্সিলর যোগ দেবেন প্রতিমন্ত্রীর বলয়ে।’

কাউন্সিলর এনামুল হক বাহার বলেন, ‘বরিশাল মহানগর আওয়ামী লীগে নেতাকর্মীদের সম্মান নেই। গত তিন বছরে আমরা দলীয়ভাবে মর্যাদা পাইনি।’

জিয়াউর রহমান বিপ্লব বলেন, ‘নগর ভবন থাকতেও সকল সভা ডাকা হয় মেয়রের বাসায়। বাসায় নিয়ে নগর উন্নয়নে কোনো সভা তো নয় বরং অপমান করা হয় কাউন্সিলরদের। আমার এলাকায় কারা দুঃস্থ সেটা তো আমি জানি। কিন্তু আমাকে না জানিয়েই সে নিজের মুখচেনা লোকদের ত্রাণ দিয়েছে করোনাকালে। এতে আমি প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছি। সাধারণ মানুষ আমাকে দোষী ভাবছে। এক পর্যায়ে আমি নিজ উদ্যেগে ২০নং ওয়ার্ডে দুঃস্থদের মাঝে ত্রাণ দিয়েছি।’

প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে যোগ দেয়ার অপেক্ষায় থাকা আরও চার কাউন্সিলর বলেন, সিটি করপোরেশনের নিয়ম অনুযায়ী কাউন্সিলরদের নিয়ে ১৪টি স্থায়ী কমিটি গঠনের নিয়ম রয়েছে। গত তিন বছরে একটি কমিটিও গঠন করেননি মেয়র। তিনি পরিষদের সভা ডাকেন বাসায়। সেখানে মেয়রের অনুসারী ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকদের রাখা হয়। তাদের সামনেই তিনি কাউন্সিলরদের অপমান করেন।

কোনো ওয়ার্ড পরিদর্শনে গেলে কাউন্সিলরদের জানানো হয় না। ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকরা থাকেন মেয়রের সঙ্গে। করোনাকলে দুঃস্থদের মধ্যে খাদ্য সহায়তা কাউন্সিলরদের না দিয়ে ওয়ার্ড সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকদের মাধ্যমে বিতরণ করা হয়েছে।

মেয়র তার অনুসারী ছাত্রলীগ-যুবলীগ নেতাকর্মীদের সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন পদে অস্থায়ী নিয়োগ দিয়েছেন। তাদের নানা অনৈতিক কর্মকাণ্ডে ব্যবহার করা হয়। কাউন্সিলরদের কোনো মূল্যায়ন তো নেই বরং জনগণের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকায় রাখা হয়েছে।

তবে নেতাকর্মীদের পেছনের কথা ভুলে গিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন মেয়র সাদিক। ৬ সেপ্টেম্বর রাতে ফেসবুক লাইভে এসে এই আহ্বান জানান তিনি।

মেয়র বলেন, ‘রাজনীতি একদিনের নয়। এটা লং প্রসেস। অনেক কিছু আমার চোখ বন্ধ করে সহ্য করতে হয় বাপ দাদার মান ইজ্জতের কথা চিন্তা করে। যে ঘটনা ঘটেছে সেটা একটা লেসন (শিক্ষা)। এটা মাথায় রেখেই আমাদের আগাতে হবে।… দেশকে উন্নয়নের দিকে নিতে সিভিল প্রশাসন, পুলিশ সবাইকে নিয়ে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। কোনো কিছুই শেষ হয়ে যায়নি, সবে শুরু।’

মেয়রের ঘনিষ্ঠ বরিশাল মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি গোলাম আব্বাস চৌধুরী দুলাল বলেন, ‌‘আওয়ামী লীগ একটি বড় দল, প্রাচীন দল। এই দলে অনেক লোক আসবে যাবে। এখানে নেতৃত্বের প্রতিযোগিতা থাকবেই। এখানকার ৯ জন কাউন্সিলর যে একজনের সঙ্গে দেখা করেছে তাতে দলের ক্ষতি হয়নি। তারা দেখা করতেই পারে। আওয়ামী লীগের বাইরের কারো সঙ্গে তো দেখা করেনি। যদি কোনো দ্বন্দ্ব থাকে তাহলে সেটা জেলা বা মহানগর আওয়ামী লীগ বা কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ সেটি সমাধান করতে পারবে।‘

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মহানগর আওয়ামী লীগের দুই নেতা বলেন, মেয়র ও প্রশাসনের দ্বন্দ্বকে পুঁজি করে সংসদ সদস্য জাহিদ ফারুখ রাজনীতিতে অবস্থান সংহত করতে চাইছেন।

সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র শওকত হোসেন হিরণের মৃত্যুর পর সাদিক আব্দুল্লাহর চাপে পরা নেতাকর্মীরা জাহিদ ফারুখের কাছে ভিড়লেও বরিশালের রাজনীতিতে আধিপত্য দেখাতে পারেননি তিনি।

জাহিদ ফারুখ বলেন, ‘কাউন্সিলররা নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই অবহেলিত। তাদের সঙ্গে কথা বলেছি, সাধারণ আলোচনা হয়েছে। দল এবং বরিশালের উন্নয়নে স্বার্থ সংশ্লিষ্ট কথা হয়েছে তাদের সঙ্গে। ভোটারদের কাছে তারা মুখ দেখাতে পারে না। আমি তাদেরও জনপ্রতিনিধি। তারাও আমার ভোটার। তাদের কথা শুনেছি এবং দল ও উন্নয়নের স্বার্থে পাশে থাকার কথা বলেছি।’
(সূত্র: নিউজ বাংলা ২৪)

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin