সেরনিয়াবাত পরিবারের বাইরে বরিশালে আ. লীগ হবে না: এডভোকেট খোকন

আলম রায়হান ও মশিউর রহমান তাসনিম:

গাণিতিক সূত্রের মতোই প্রতিষ্ঠিত বিষয়, ‘রাজনীতি কোন প্রোডাক্ট নয়, রাজনীতি একটি প্রসেস।’ এই প্রসেসেই গড়ে ওঠেন রাজনৈতিক নেতা-কর্মী। আবার এই প্রসেস কোন রুটিন মেনে চলে না। আঁকাবাঁকা অনিশ্চিত ঝুকিপূর্ণ পথে চলে রাজনীতি। এই প্রক্রিয়ায় গড়ে উঠেছেন এডভোকেট রফিকুল ইসলাম খোকন। যিনি ‘মামা খোকন’ নামে সমধিক পরিচিত। তিনি মনে করেন, রাজনীতিতে চার প্রজন্মের সেরনিয়াবাত পরিবারের বাইরে বরিশালে আওয়ামী লীগ হবে না।

এডভোকেট রফিকুল ইসলাম খোকনের সাথে কথা হয় ১৫ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় বিসিসি ৭ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর কার্যালয়ে। তিনি প্যানেল মেয়র এবং বরিশাল বারের সাধারণ সম্পাদক। এছাড়া জড়িত রয়েছেন নানান সামাজিক সংগঠনের সঙ্গে। রাজনীতিতে তিনি লড়াকু সৈনিক হিসেবে পরিচিত। আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে থাকাকালে বরিশালের প্রতিটি আন্দোলনে তিনি ছিলেন সক্রিয়। দীর্ঘ পলাতক জীবনে ঢাকায় অবস্থানকালেও সক্রিয় থেকেছেন ঢাকার রাজপথে দলীয় কর্মসূচিতে। তা হোক সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচি, লগি-বৈঠা আন্দোলন বা অন্য কোন কর্মসুচি।

নবম শ্রেনীর ছাত্র থাকাকালে রফিকুল ইসলাম খোকন রাজনীতিতে এসেছেন ঘটনাচক্রে। তখন তিনি বরিশাল নগরীর ঐতিহ্যবাহী এ কে স্কুলের ছাত্র। তখন রাজনীতির ‘র’ও বুঝতেন না। এমনকি যারা তাকে রাজনীতিতে এনেছিলেন তাদেরকেও চিনতেন না এবং পরে আর খুঁজে পাননি। তবে ধারণা করা হয়, তাঁকে রাজনীতিতে এনেছিলেন জাতীয় ছাত্রলীগ নেতারা। এই সূত্রে তাকে একদিন বাকশাল অফিসে আসতে বলা হলো। তিনি তখন বাকশাল-এর অর্থও বোঝেন না। তবুও তিনি বরিশাল বাকশাল অফিসে গিয়েছিলেন বেশ উৎসাহ নিয়ে। কিন্তু প্রচন্ড হোঁচট খেলেন যখন বিবর্ণ সিলভারের দুই তিনটি কাপে অনেকের চায়ে আপ্যায়ন পর্ব শুরু হলো। এই ঘটনা তাকে রাজনীতির ধারা থেকে দূরে নিয়ে যেতে পারতো। কিন্তু তেমনটা ঘটেনি।

আবদুর রাজ্জাকের নেতৃত্বে রহস্যজনক কারণে আওয়ামী লীগের একটি অংশ নিয়ে গঠিত বাকশাল আবার মূল ধারায় ফিরে আসায় ছাত্রলীগ ও জাতীয় ছাত্রলীগ একীভূত হয়। এই ঐক্য রাজনীতিতে রফিকুর ইসলাম খোকনকে অধিকতর উদ্যোমী করে তোলে। পর্যায়ক্রমে এগিয়ে বরিশাল ছাত্র রাজনীতিতে তার একটি উল্লেখযোগ্য অবস্থান সৃষ্টি হয়, তিনি বরিশাল জেলা ছাত্রলীগের প্রচার সম্পাদক ছিলেন। তবে বরিশালের রাজনীতিতে তার জোরালো ভিত্তির সূচনা হয় ১৯৯৯ সালে বরিশাল ল’ কলেজের ভিপি নির্বাচিত হবার মাধ্যমে। তিনি জনপ্রতিনিধি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছেন ২০১৮ সালে ৩০ জুলাই অনুষ্ঠিত বরিশাল সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে। তিনি নগরীর ৭ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছেন। দায়িত্ব পেয়েছেন প্যানেল মেয়রের। রফিকুল ইসলাম খোকন আরো উজ্জ্বল হয়েছেন বরিশাল বারের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে। বর্তমান তিনি এই পদে রয়েছেন। অনেকে মনে করেন, রাজনীতির  প্রশ্বস্ত পথের দৃপ্ত পথিক এডভোকেট রাফিকুর ইসলাম খোকন।

আজকের অবস্থানে পৌঁছাতে এডভোকেট রফিকুর ইসলাম খোকনকে হাঁটতে হয়েছে রাজনীতির কঠিন পথ। এক্ষেত্রে ১৫ আগস্ট শোক দিবস পালন তার চেতনার সঙ্গে মিশে গেছে শৈশবেই। যেসময় এ দিবসটি পালনে মানুষের আকাল ছিলো তখনও সক্রিয় ছিলো কিশোর রফিকুর ইসলাম খোকন। এ জন্য তাঁকে অনেক বৈরী পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হয়েছে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমি শিশুকাল থেকে ১৫ আগস্টের অনুষ্ঠানে অংশ নিচ্ছি। এখন আমরা ১৫ আগস্ট শোক দিবস পালন অনুষ্ঠানে খাসির তেহারী বিতরণ করি। কিন্তু আমাদের কৌশোরে বিতরন করা হতো জিলাপী। এবং ১৫ আগস্ট শোক দিবস পালন করতে হতো বৈরী অবস্থার মধ্যে। এরশাদের সামরিক শাসন আমলে ১৪ আগস্ট রাতে নাজিরের পুল এলাকায় মাইক ফিট করে আমরা দুজন একটি বেঞ্চে শুয়ে ছিলাম। রাতে আর্মি এসে মাইক খুলে ফেললো। আমাদের তাড়িয়ে দিলো। জিয়ার শাসনামলে মাইক ভেঙ্গে ফেলেছে। ১৯৯১ সালে সোহেল হত্যাকান্ডের দিন আমি গুলিবিদ্ধ হয়েছি। সেই গুলি এখনো আমার শরীরে আছে।

রফিকুল ইসলাম খোকন রাজনীতিতে এগিয়েছেন নানান বৈরী পরিস্থিতি মোকাবিলা করে। পুলিশ কামাল ও রাহাত হত্যাসহ দুটি হত্যা মামলা এবং আরো ১১টি মিথ্যা মামলার শিকার হয়েছেন তিনি। এখানেই শেষ নয়। এই ১৩ মামলায় হাইকোর্টের আদেশে জামিন পেয়ে জেল থেকে বাইরে পা দেবার সাথেসাথে তাকে আবার আটক করা হয়। দাগী আসামীর মতো পরানো হয় হ্যান্ডক্যাপ। যার প্রতিবাদ করেছিলেন তিনি। পরে তাকে ৫৪ ধারায় আটক দেখিয়ে ডিটেনশন দেয়া হয়েছে। এর আগে-পরেও তিনি একাধিকবার জেল খেটেছেন। ৯১ সালের জামায়াত-বিএনপি সরকারের আমলের বুলেট এখনো শরীরে বয়েচলা এডভোকেট রফিকুর ইসলাম খোকন আবার গুলিবিদ্ধ হয়েছেন তার দল ক্ষমায় থাতাকালেই গত ১৮ আগস্ট বরিশাল সদর উপজেলা কমপ্লেক্সে। অই দিনের ঘটনায় তাঁর শরীর থেকে ৩৪টি স্পিন্টাল অপসারণ করা হয়েছে। ধারণা করা হয়, এখনো রয়েগেছে বেশ কয়েকটি। এর পরও অই ঘটনা সম্পর্কে বললেন, ‘দল-সরকার-প্রশাসন আমাদেরই, সেদিন একটি ঘটনা ঘটেগেছে!’

রাজনীতির কারণে জেল-জুলুম নির্যাতন ভোগ করাই শেষ কথা নয়, পিতা হিসেবেও এডভোকেট রফিকুল ইসলাম খোকনকে ভোগ করতে হয়েছে নিদারুন বেদনা। রাজনীতির বৈরী পরিস্থিতে বরিশাল ছেড়ে পলাতক জীবনের সূচনায় প্রথম সন্তানকে এক বছর বয়সী দেখে গেছেন, পলাতক জীবনের কাটিয়ে তিনি যখন পরিবারের কাছে ফিরে আসেন তখন প্রিয় সন্তানের বয়স ১১ বছর। এ ঘটনা তার ব্যক্তি জীবনে একরকম ‘এক-এগারো’ ট্রাজেডী হয়ে থাকলো। মাঝখানের প্রায় এক দশক কেটেছে দেশে-বিদেশে তার পলাতক জীবন। এ ব্যাপারে তার উচ্চারণ, এই দশ বছর আমাকে কেউ ফিরিয়ে দিতে পারবে না। এরপরও তেমন কোন আক্ষেপ নেই এডভোকেট রফিকুর ইসলাম খোকনের। এ প্রসঙ্গে তিনি বললেন, রাজনীতিতে জেল-জুলুম-নির্যাতন মুদ্রার এপিট-ওপিট।

প্রশ্ন: এরপও কি কখনো রাজনৈতিক কষ্টের দরিয়া অতি গভীর মনে হয় না? যখন একা ভাবেন, সেই পরিস্থিতি কীভাবে সামাল দেন?

উত্তর: এমনটা হলে আমাদের নেতা-কর্মীদের দিকে তাকাই। দেখেন, দেশের জন্য, দলের জন্য, রাজনীতির জন্য আওয়ামী লীগের কতো নেতা-কর্মীকে জীবন দিতে হয়েছে, এর কোন সীমা পরিসীমা নেই। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দিকে তাকান। তাঁর জীবন বলতে গেলে জেলেই কেটেছে। বারবার মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছেন দেশের মানুষে জন্য রাজনীতি করার কারণে। জেল-জুলুম-নির্যাতন ভোগ করেছেন। বারবার মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়েছেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘাতকের বুলেটে ইতিহাসের মহানায়ক স্বপরিবারে প্রাণ দিয়েছেন। বিদেশে থাকার কারণে বেঁচেগেছেন তাঁর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা।

বঙ্গবন্ধু কন্যা আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাকে অন্তত ১৯ বার হত্যা করার চেষ্ট করা হয়েছে। ২১ আগস্ট গ্রেনেড ও গুলি করে তাঁকে হত্যা চেষ্টার সময় তিনি অলৌকিকভাবে বেঁচেগেছেন। অই দিন আইভি রহমানসহ নিহত হয়েছেন ২৪জন। এরপরও বঙ্গবন্ধু কন্যা দেশ ও মানুষের জন্য রাজনীতি করে যাচ্ছেন।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘাতক বাহিনীর বুলেটে যুবলীগ চেয়ারম্যান শেখ ফজলে শামস্ পরশ ও ডিসিসি মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপশ শিশুকালে মা-বাবাকে হারিয়েছেন। এই বেদনার মধ্যেও তাঁরা দেশের মানুষের জন্য রাজনীতি করছেন।

বরিশালের আমাদের রাজনীতির অভিভাবক আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ প্রসঙ্গে আসেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তিনি পিতা-পুত্র-ভাই-বোনসহ পরিবারের ৬ জনকে হারিয়েছেন। সেদিন তিনিও বেঁচেগেছেন ঘটনাচক্রে। এছাড়াও তাকে একাধিকবার হত্যার অপচেষ্টা হয়েছে। এরপরও তিনি হাল ছাড়েননি। আমাদের নেতাদের এইসব ত্যাগ থেকে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা অনুপ্রেরনা লাভ করেন, সাহস অর্জন করেন।

অপর এক প্রশ্নের জবাবে এডভোকেট রফিকুল ইসলাম খোকন বলেন এখন ‘সবাই আওয়ামী লীগ’- এটাই হচ্ছে বড় সমস্যা। এখন আর কেউ বিএনপি করে না, জামায়াত তো কেউ করেইনা! ফলে কে প্রকৃত বন্ধু আর কে ঘরের শত্রু বিভিষণ তা চেনা কঠিন। এছাড়া আর কোন সমস্যা সেই। আগামী নির্বাচন প্রসঙ্গ রফিকুল ইসলাম খোকন বলেন, এবার নির্বাচনে বিএনপি আসবে এবং নির্বাচন করতেই আসবে। সকল দলের সক্রিয় অংশ গ্রহনে আগামী নির্বাচন হবে।

প্রশ্ন: নির্বাচনের ফলাফল কি হবে?

উত্তর: আওয়ামী লীগ বিজয়ী হবে।

প্রশ্ন: কারণ?

উত্তর: বিগত নির্বাচনগুলোতে আওয়ামী লীগকে মানুষ যে কারণে ভোট দিয়েছে সেই একই কারণেই আগামীতেও জণগন আওয়ামী লীগকেই ভোট দেবে। মানুষ অনেক সচেতন। এখন আর মিথ্যা প্রচারণা দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করা যায় না। আর নতুন প্রজন্ম ভোটের রাজনীতি একটি বড় ফ্যাক্টর। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশকে উন্নয়নের যে অবস্থানে নিয়ে গেছেন তাতে মানুষ বিকল্প চিন্তা করবে না। পাশাপাশি সকলের কাছেই স্পষ্ট হয়েছে, বিএনপি-জামায়াত জোটের রাজনীতি কেবলই অপপ্রচারের। দেশকে দেবার মতো তাদের কিছুই নেই। বিপরীতে আওয়ামী লীগ দেশকে অনেক কিছু দিয়েছে। আরো অনেক কিছু দেবার আছে। এই বাস্তবতা দেশের মানুষ অতীতের যেকোন সময়ের চেয়ে বেশি অনুধাবন করছেন। এ হচ্ছে বাংলাদেশের বাস্তবতা।

প্রশ্ন: বরিশালে আওয়ামী লীগের অবস্থা কী, নানান রকম তৎপরতার কথা শোনা যাচ্ছে?

উত্তর: বরিশাল আওয়ামী লীগ সঠিক পথেই আছে। একটি বিষয় মনে রাখতে হবে, সেরনিয়াবাত পরিবারের বাইরে বরিশালে আওয়ামী লীগের রাজনীতি হবে না। রাজনীতিতে এই পরিবার আছে চার প্রজন্ম ধরে। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট এই পরিবারে ৬ জন শহীদ হয়েছেন। এই পরিবারকে বিনাশ করার অপচেষ্টা হয়েছে অনেক । কিন্তু এ অপচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে।

রফিকুল ইসলাম খোকন, ছাত্র নেতা থেকে শুরু করে জনপ্রতিনিধি, আইনজীবি, আইনজীবি নেতাসহ নানান পরিচয়ে পরিচিত। কিন্তু সকল কিছু ছাপিয়ে তাঁর নামের সাথে যুক্ত হয়েগেছে ‘মামা’ শব্দটি। ‘মামা খোকন’ না বললে অনেক সময় তার ঘনিষ্ঠ জনদেরও চিনতে অসুবিধা হয়। এ প্রসঙ্গে এডভোকেট খোকন বলেন, শুরু দিকে আমার সঙ্গে আমার ভাগ্নে ছিলো। সঙ্গত কারণেই সে আমাকে মামা বলতো। তার সমবয়সীরা আমাকে মামা ডাকতো। এ ভাবেই মামা শব্দটি আমার নামের সঙ্গে যুক্ত হয়। এক পর্যায়ে হাসনাত ভাই ‘মামা খোকন’ বলা শুরু করলেন। এভাবেই আমার এ নামটি প্রতিষ্ঠিত হয়েগেছে!

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin