১৮ বছর ধরে লেবুখালীতে ফেরি চালাচ্ছেন জাকির হাওলাদার। পায়রা সেতুতে গাড়ি চলাচল শুরু হওয়ায় রোববার এই নৌপথে শেষবারের মতো ফেরি চালিয়েছেন তিনি।
এই দক্ষ চালকের হাত ধরে শেষ হলো একটি অধ্যায়ের। এই পথে আর কখনও দেখা মিলবে না ফেরির। লেবুখালী ঘাট থেকে রোববার বেলা সোয়া ১১টার দিকে শেষ ফেরিটি নিয়ে অন্য পাড়ে রওনা দেন জাকির।
ঘাট ছাড়ার আগে ছলছল করে ওঠে জাকিরের চোখ। এক যুগের বেশি সময়ের পেশাগত জীবনের কতশত স্মৃতি মনে পড়ে তার। কথা বলতে গিয়ে শুরুতে গলাটা ধরে আসে জাকিরের। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নেন তিনি। জানান, এক মিশ্র অনুভূতিতে ডুবে আছেন। এখান থেকে চলে যেতে হবে, সেই বিচ্ছেদ যেমন তাকে পোড়াচ্ছে আবার যাত্রীরা সহজেই গন্তব্যে পৌঁছাবেন, সেই আনন্দে ভাসছেন তিনি।
পুরো যৌবনই তার এখানে কেটেছে জানিয়ে জাকির বলেন, ‘এখন বগায় ফেরি চালাতে হবে। এখান থেকে সাত দিন পর বগা, বেকুটিয়াসহ বিভিন্ন রুটে চলে যাব। অনেক স্মৃতি এখানে। কষ্ট লাগছে, কিন্তু ভালোও লাগছে।’
‘আমাদের সরকারি চাকরি। কোনো আক্ষেপ নেই, বরং খুশি আমরা। কেননা এই অঞ্চলের সাধারণ মানুষের কষ্ট শেষ হচ্ছে পায়রা সেতুর মাধ্যমে। এর জন্য আমরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে কৃতজ্ঞ।’
শেষ ফেরিতে আল্লাহর দান পরিবহনের একটি বাসের যাত্রী সঞ্জিত মিত্রর সঙ্গে কথা হয় । তিনি জানান, শেষ ফেরির যাত্রী হতেই ঘুরতে গিয়েছেন।
ওই বাসের যাত্রীদের একজন নিপা রহমান জানান, তিনি পটুয়াখালী সদরের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক; বাড়ি বরিশালের নথুল্লাবাদে। কাজে যোগ দিতে প্রতিদিনই তাকে ফেরিতে চড়ে পায়রা পাড়ি দিতে হতো।
‘আজও ফেরিতে চড়ে কাজে গেলাম। ফিরব সেতু দিয়ে। ফেরিতে নানা দুর্ভোগ থাকলেও এই অভিজ্ঞতা মিস করব।’
ফেরির আরেক বাসের যাত্রী মো. জাকির বলেন, ‘ওষুধ কোম্পানির বিক্রিয় প্রতিনিধি হওয়ায় কাজের স্বার্থে বরিশালের বাকেরগঞ্জ থেকে পটুয়াখালী শহর ও কুয়াকাটায় দিনে দুই থেকে তিনবার যাওয়া-আসা করা লাগে।
‘ফেরিতে বেশ ভোগান্তি হতো। ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করা লাগত। এখন সেতু চালু হওয়ায় দিনে আপ-ডাউন করতে চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা আমার সেভ হবে। আজ ফেরির শেষ যাত্রার সাক্ষী হলাম।’
এই রুটের আরেক ফেরির চালক মাহাবুবুর রহমান বলেন, ‘চারটি ফেরি এখানে নিয়মিত চলাচল করত। আমি দুই বছর ধরে এখানে ফেরি চালাই। ফেরি এখানে বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আমারও খারাপ লাগছে, তবে ভালো লাগাটা বেশি। পায়রা সেতু উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে নতুন মাত্রা সৃষ্টি হয়েছে এই অঞ্চলে। আমার নতুন কর্মস্থল এখন বেকুটিয়ায়।’
লেবুখালীর ফেরিগুলোতে চালক ও যাত্রীদের পছন্দের খাবার চিড়া ভাজা। ফেরি চলাচল বন্ধের খবরে বিক্রেতাদের চোখে-মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ।
বাকেরগঞ্জের শাহজাহান সিকদার জানান, লেবুখালী ঘাটে দুই বছর ধরে হাশেমের চিড়া ভাজা বিক্রি করছেন তিনি। তাতে ভালোমতোই চলছিল সংসার।
শাহজাহান নামে চিড়া বিক্রেতা বলেন, ‘সেতু চালু হইয়া গেল। এখন কী করমু বুঝতাছি না। ঢাহায় আত্মীয়স্বজন থাহে। হেগো লগে কথা কইছি কামের লইগ্গা। মাথায় কাম করে না কোনো। ঘরে তো সব না খাইয়া থাকবে।’
২০ বছর ধরে সেখানে চিড়া বিক্রি করছেন আনোয়ার হাওলাদার। তিনি বলেন, ‘সুবিদখালী বাড়ি আমার। হাশেমের চিড়া ভাজা ফেরিতে বেচি ২০ বছর ধইরা। ডেইলি ২ হাজার টাহা বেচতে পারলে মালিক ৫০০ টাহা দেয়। ব্রিজ উদ্বোধন হইতে আছে আইজ। এরপর যে কী করমু বুঝি না। ঘরে পোলাপান, বাপ-মা আছে। ক্যামনে কী করমু?’
ক্রেতারাও জানালেন, এই চিড়া ভাজার কথা তাদের সব সময় মনে পড়বে।
ফেরির যাত্রী রহিম শেখ বলেন, ‘লেবুখালী ফেরিতে উঠলেই হাশেমের চিড়া ভাজা কিনতাম। মূলত এই চিড়া ভাজা লেবুখালী ফেরিকে কেন্দ্র করেই বিক্রি হতো। শুধু আমি নই, অসংখ্য মানুষ হাশেমের এই চিড়া ভাজা মিস করবেন।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রোববার বেলা ১১টায় গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে পটুয়াখালীর লেবুখালীতে পায়রা নদীর ওপর বহুল প্রতিশ্রুত সেতুর উদ্বোধন করেছেন। এর মধ্য দিয়ে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে সড়ক যোগাযোগের নতুন দ্বার উন্মোচিত হয়েছে। পাশাপাশি শেষ হয়েছে বরিশাল-কুয়াকাটা রুটের ফেরির দিন।
পায়রা সেতু চালু হওয়ায় বরিশাল থেকে বাসে কুয়াকাটা যেতে এখন সময় লাগবে আড়াই থেকে তিন ঘণ্টা। মাইক্রোবাস, প্রাইভেট কার বা মোটরসাইকেলে আরও দ্রুত যাওয়া যাবে এই অঞ্চলের পর্যটন স্পটগুলোতে।